
ঢাকা মেট্রোরেলে অভিনব কৌশলে দীর্ঘদিন ধরে চলছিল ভাড়া জালিয়াতি। একই স্টেশনে কার্ড স্ক্যান করে ভেতরে প্রবেশ করে অন্য যাত্রীকে সেই কার্ড দিয়ে বিনা ভাড়ায় ভ্রমণের সুযোগ নিচ্ছিল একটি সংঘবদ্ধ চক্র। এই জালিয়াতির কারণে লাখ লাখ টাকা রাজস্ব ক্ষতির মুখে পড়ে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ। অবশেষে ফাঁদে ফেলতে গিয়ে যাত্রীবান্ধব ‘একই স্টেশনে বিনা ভাড়ায় প্রবেশ ও বাহির’ সুবিধা বন্ধ করে দিয়েছে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)।
নতুন নিয়ম অনুযায়ী, স্টেশনে ঢুকে মেট্রোরেলে না চড়ে বের হয়ে গেলে যাত্রীকে ১০০ টাকা জরিমানা দিতে হবে।
কেউ একই স্টেশনে কার্ড স্ক্যান করে প্রবেশের পর এক্সিট করলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ১০০ টাকা ভাড়া কাটা হবে।
এর আগে, যাত্রী ভুলবশত বা জরুরি প্রয়োজনে স্টেশনে ঢুকে ১৫ মিনিটের মধ্যে বেরিয়ে গেলে কোনো ভাড়া দিতে হতো না। কিন্তু চক্রের অপব্যবহারের কারণে সেই সুবিধা বাতিল করা হয়েছে।
কারওয়ান বাজার স্টেশনের এক কর্মকর্তা বলেন, “এখন থেকে স্টেশনের ভেতর দিয়ে ফ্রি এক্সিট-এন্ট্রি নেওয়া যাবে না। নতুন নিয়ম কার্যকর হয়েছে।”
ডিএমটিসিএল সূত্রে জানা গেছে, একটি সংঘবদ্ধ চক্র এমআরটি পাস বা র্যাপিড পাস কার্ড ব্যবহার করে ‘ঢুকতেন একজন, বের হতেন আরেকজন’ কৌশলে প্রতিদিন বিনা ভাড়ায় যাতায়াত করছিল।
চক্রের সদস্যরা দুটি দলে ভাগ হয়ে কাজ করত। এক দল ট্রেন ছাড়ার স্টেশনে, অন্য দল গন্তব্যে।
স্টেশনে ঢোকার সময় প্রথম ব্যক্তি কার্ড স্ক্যান করে ভেতরে প্রবেশ করতেন। এরপর তিনি কার্ডটি ভেতরে থাকা সহযোগীকে দিয়ে দিতেন। সহযোগী কার্ডটি স্ক্যান করে “বেরিয়ে” যেতেন। ফলে সিস্টেমে দেখা যেত, যাত্রী একই স্টেশনে প্রবেশ ও প্রস্থান করেছেন — কোনো ভাড়া কাটা হয়নি। অথচ প্রথম ব্যক্তি সেই ট্রেনে চড়ে গন্তব্যে পৌঁছাতেন, যেখানে অপেক্ষমাণ আরেক সদস্য তাকে বের হতে সাহায্য করত।
একাধিক স্টেশনের সিসিটিভি ফুটেজ ও ইলেকট্রনিক টিকিটিং রেকর্ড বিশ্লেষণে এমন ১০টিরও বেশি ঘটনার প্রমাণ পেয়েছে ডিএমটিসিএল। কর্তৃপক্ষের আশঙ্কা, প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি।
এক কর্মকর্তা বলেন, “প্রতিদিন আড়াই লাখেরও বেশি যাত্রী মেট্রোরেল ব্যবহার করেন। এত বড় পরিসরে অনিয়ম শনাক্ত করা কঠিন। তবু আমরা বেশ কিছু কার্ডের ডেটা বিশ্লেষণে বুঝতে পেরেছি, একই স্টেশনে বারবার ফ্রি প্রবেশ-প্রস্থানের রেকর্ড পাওয়া যাচ্ছে।”
যাত্রীদের অভিযোগ, একটি চক্রের প্রতারণার দায় এখন সাধারণ মানুষকে বহন করতে হচ্ছে। ‘ঢাকা মেট্রোরেল হেল্পলাইন’ নামে একটি ফেসবুক গ্রুপে নতুন নিয়ম নিয়ে তিন হাজারেরও বেশি প্রতিক্রিয়া এসেছে।
একজন যাত্রী লিখেছেন, “যদি কেউ অসুস্থ হয়ে পড়ে বা জরুরি প্রয়োজনে বের হতে হয়, তাহলে কেন ১০০ টাকা জরিমানা দিতে হবে? ন্যূনতম ভাড়া কাটা যেতে পারে, কিন্তু সবার ওপর একই নিয়ম অন্যায্য।”
আরেকজন মন্তব্য করেন, “মাথা ব্যথা হলে তার ব্যবস্থা নিতে হয়, কিন্তু মাথা কেটে ফেলা সমাধান নয়। চক্রটিকে ধরুন, নির্দোষ যাত্রীকে নয়।”
মেট্রোরেলের নিয়মিত যাত্রী আলিমা নুমা বলেন, “আগে ২০ টাকা থাকলেই জরুরি প্রয়োজনে ঢুকে কয়েক মিনিটে বেরিয়ে যেতে পারতাম। এখন সেই সুযোগ নেই। ভুলবশত ঢুকলে ১০০ টাকা কাটা অন্যায়।”
নতুন নিয়মের বিষয়টি নিয়ে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে কর্মীদের মধ্যেও। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মী জানান, “কোনো অফিসিয়াল ঘোষণা ছাড়াই হঠাৎ কার্ড এক্সিট কাজ করা বন্ধ হয়ে যায়। আমরা নিজেরাও জানতাম না। এতে যাত্রীরা ভোগান্তিতে পড়েন।”
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, “আমরা মানুষকে সুবিধা দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কিছু মানুষ সুযোগের অপব্যবহার করে দুই নম্বরি কাজ করছে। এতে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা ক্ষতি হচ্ছে। তাই বাধ্য হয়েই এই ব্যবস্থা নিতে হয়েছে।”
তবে অনেকের মতে, নিয়মটি হঠাৎ কার্যকর হওয়ায় অপারেশনাল জটিলতা ও যাত্রী অসন্তোষ বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রযুক্তিগতভাবে লক্ষ্যভিত্তিক নজরদারি ও জালিয়াতি শনাক্তকরণ পদ্ধতি চালু করলে সাধারণ যাত্রীদের ক্ষতি না করেও ভাড়া ফাঁকি রোধ করা সম্ভব।
আপনার মতামত লিখুন :